আমাদের অভিজ্ঞ ও দক্ষ কাউন্সেলরগণ তাদের ক্লায়েন্ট দেখার সময় মানোবিজ্ঞানের পদ্ধতিসমূহ অত্যন্ত বিচক্ষনতার সাথে ব্যবহার করেন। যেমনঃ
১। ব্যক্তি কেন্দ্রিক চিকিৎসা (Client Centered Therapy)
২। মনোযোগিতা কেন্দ্রিক প্রত্যক্ষ জ্ঞান সম্বন্ধীয় চিকিৎসা (MBCT)
৩। নিউরো লিংগুয়েস্টিক প্রোগ্রামিং (NLP)
৪। ই.এম.ডি.আর (EMDR, Level-1)

ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা পদ্ধতি
একজন চিকিৎসক হিসেবে কার্ল রজারস্ -এর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনোচিকিৎসা পদ্ধতির উৎপত্তি ঘটেছে। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে রজারিয়ান মনোচিকিৎসা পদ্ধতিও বলা হয় যেটা একটা মানবতাবাদী পদ্ধতি এবং ১৯৪০ এর দশকে শুরু করে ঊনাশির ১৯৮০ এর দশকে এসে একটা পূর্ণতা লাভ করে। ব্যক্তি কেন্দ্রিক মনোচিকিৎসা পদ্ধতিতে কাউন্সেলর ক্লায়েন্টকে শর্তহীনভাবে গ্রহণ, কাউন্সেলরের সংগতি এবং ক্লায়েন্টকে সহমর্মিতার সাথে বুঝতে পারার মাধ্যমে ক্লায়েন্টকে তার সর্বোৎকৃষ্ট সন্তুষ্টি অর্জনে সাহায্য করা হয়।

ব্যক্তি কেন্দ্রিক মনোচিকিৎসার প্রয়োজনীয় শর্ত

রজারস্ (১৯৫৭,১৯৫৯) এই পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিম্নাোক্ত ৬টি প্রয়োজনীয় শর্তের কথা বর্ণনা করেছেন।

১। কাউন্সেলর-ক্লায়েন্টের মানসিক সম্পর্ক : কাউন্সেলর এবং ক্লায়েন্টের মধ্যে অবশ্যই একটি সম্পর্ক থাকবে এবং এটা এমন একটা সম্পর্ক যেখানে উভয়ই উভয়কে সম্মান প্রদর্শণ করবে।

২। ক্লায়েন্টের অসামঞ্জস্যতা : ক্লায়েন্টের অসংগতি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সচেতনতার মধ্যে থেকেই সৃষ্ট।

৩। কাউন্সেলরের সংগতি বা অকৃত্রিমতা : কাউন্সেলরগণ তাদের চিকিৎসা বা পেশাগত জীবনে কাউন্সেলর-ক্লায়েন্টের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অকৃত্রিম হবেন। কাউন্সেলর এই সম্পর্কের ক্ষেত্রে গভীরভাবে জড়িত থাকবেন এবং তারা শুধুমাত্র ক্লায়েন্টের সাহায্য করার জন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ই প্রকাশ করতে পারবেন।

৪। কাউন্সেলরের শর্তহীনভাবে ক্লায়েন্টকে গ্রহণ : কাউন্সেলর ক্লায়েন্টকে কোনো প্রকার শর্ত, সিদ্ধান্ত, অনুমোদন-অননুমোদন ইত্যাদি ছাড়াই ক্লায়েন্টকে গ্রহণ করবে। এইটা ক্লায়েন্টের মধ্যে আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করবে। তারা এটাও উপলব্ধি করতে পারবে যে, কীভাবে তার নিজের আত্মসম্মান অন্যের দ্বারা বিবৃত হচ্ছে।

৫। কাউন্সেলরের সহমর্মিতার বোঝাপড়া : কাউন্সেলর ক্লায়েন্টের অন্তর্নিহিত চিন্তা-ভাবনাকে সহমর্মিতার সাথে গ্রহণ করবে। কাউন্সেলর ক্লায়েন্টের প্রতি সঠিক সহমর্মিতা প্রদর্শন করবে ফলে ক্লায়েন্ট নিজের প্রতি কাউন্সেলরের অকৃত্রিম এবং শর্তহীন সম্মান-ভালোবাসা বুঝতে পারবে।

৬। ক্লায়েন্টের উপলব্ধি : ক্লায়েন্ট কমপক্ষে কাউন্সেলরের প্রতি শর্তহীন ইতিবাচক সম্মান এবং সহমর্মিতার বোঝাপড়া সম্পর্কে উপলব্ধি পাবে। উপোরিউক্ত ধাপ ৩, ৪, ও ৫-ই হল এই পদ্ধতির প্রধান শর্ত এবং এগুলোকে ‘মূল শর্ত’ বলে।

 

প্রক্রিয়া :

কার্ল রজারস্ বিশ্বাস করতেন যে, একজন কাউন্সেলর যিনি তিনটি কঠিন এবং ইতিবাচক মনোভাবকে (কাউন্সেলরের অকৃত্রিমতা , ক্লায়েন্টকে শর্তহীনভাবে গ্রহণ এবং কাউন্সেলরের সহমর্মিতা) বাস্তবে রূপ দান করনে। তিনি ক্লায়েন্টকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিবেন যাতে করে ক্লায়েন্ট- কোনো প্রকার ভয়-ভীতি ব্যতিত, আত্মবিশ্বাসের সাথে তার অনুভূতিগুলি প্রকাশ করতে পারেন। ক্লায়েন্ট সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যাদি আবিষ্কারের জন্য ব্যক্তি কেন্দ্রিক মনোচিকিৎসক কখনোই ক্লায়েন্ট যেভাবে কথাবার্তা বলেন, চলাফেরা করেন তাতে আপত্তি করে না । এমনকি কোনো ধরণের পরামর্শ পর্যন্ত দেওয়া যাবে না।
কার্ল রজারস্ তার ক্লায়েন্টকে কি করতে হবে বা কী করা উচিত সেটি তিনি কখনোই বলতেন না কিন্তু বিশ্বাস করতেন যে, তারা কী করবে বা কী করা উচিত সেটা ক্লায়েন্টের কথা-বার্তার মধ্যেই নিহিত আছে, কাউন্সেলরের মধ্যে না। এক্ষেত্রে কাউন্সেলরের কাজ হচ্ছে ক্লায়েন্টের জন্য সুবিধাজনক, সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরী করা যাতে করে ক্লায়েন্ট তার নিজের সমাধান খুঁজে পায়।

মাইন্ডফুলনেস বেইজড কগনিটিভ থেরাপি (MBCT)

মাইন্ডফুলনেস বেইজড কগনিটিভ থেরাপি (MBCT) এক ধরনের মনোচিকিৎসা পদ্ধতি, যেটা বিষাদগ্রস্থ রোগীর পুনরাক্রমণ-প্রতিরোধ পদ্ধতি হিসেবে প্রথমে আকিষ্কৃত হয়। এই MBCT, কগনিটিভ থেরাপির একটি সংশোধিত রূপ এবং এর সাথে ধ্যান ও শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়াকে যুক্ত করা হয়েছে। MBCT কাউন্সেলরগণ এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তাদের রোগীকে শিখান কীভাবে তারা নেতিবাচক চিন্তাভাবনাকে দূরীভূত করবে। কারণ নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা তাদের স্থায়ীভাবে বিষাদ-গ্রস্থতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই এটা স্থায়ী রূপ লাভের পূর্বেই ক্লায়েন্টেকে শিখানো হয়- কীভাবে তারা এটা মোকাবিলা করবে। এটা প্রমাণিত যে, MBCT পদ্ধতি মাত্রাতিরিক্ত বিষাদগ্রস্থ ক্লায়েন্টের জন্য খুবই কার্যকর। মাইন্ডফুলনেস বেইজড পুরাক্রমণ প্রতিরোধ পদ্ধতি সাধারণ উদ্বেগ রোগ (GAD) এবং মাদকাসক্ত চিকিৎসার জন্য খুবই দরকারী। যাদের শারীরিক অসুস্থতা যেমন : রক্তনালীতে সংক্রমণ এবং মারাত্মকভাবে মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত তাদের ক্ষেত্রে বিষাদগ্রস্থতা দেখা দিলে এর লক্ষণসমূহ ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।
মাঝে মধ্যে সামান্য কিছু দুঃখ ও যারা বিষাদগ্রস্থতা থেকে সুস্থ হয়েছে তাদেরকে পুনরায় আবার বিষাদগ্রস্থতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই দুঃখ বা শোককে অথবা নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বা দেওয়া বা এড়িয়ে যাওয়ার চেয়ে ধ্যানের মাধ্যমে এবং মাইন্ডফুলনেস বেইজড অনুশীলন করার মাধ্যমে নেতিবাচক চিন্তার সাথে যে ব্যক্তির সম্পর্ক সেটা পরিবর্তন করা শিখতে হয়। এই ধরণের ধ্যান বা মাইন্ডফুলনেস চর্চা রোগীর  স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে পুন : সমতা আনয়ণ করে, ক্লায়েন্টকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে এই একই অবস্থাতেই যে আরো বিকল্প অন্যভাবে সাড়া দেওয়া যায় সেটা বুঝতে সাহায্য করে। ক্লায়েন্ট যদি নিয়মিতভাবে ধ্যান চর্চা করে তবে যখনই সে কোনো নেতিবাচক পরিস্থিতিতে পড়ছে তখনই সে সেটা ব্যবহার করতে পারবে। যখন ক্লায়েন্ট সামান্যতম শোকার্ত, দুঃখিত ও কষ্ট পায়, তখনই সে তার বিষাদগ্রস্থতার উপকরণগুলোকে মিশিয়ে ফেলে এবং বিষাদগ্রস্থতার দিকে এগিয়ে যায়, এই ক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট যদি ধ্যানের সমস্ত পদ্ধতি সঠিকভাবে নিয়ম মেনে করে তখন সে এই নেতিবাচক চিন্তাকে ইতিবাচকে রূপান্তরিত করে।

নিউরো লিংগুয়েসটিক প্রোগ্রামিং (NLP)

১৯৭০ এর দশকে রিচার্ড বেন্ডলার এবং জন গ্রিনভার আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে নিউরো লিংগুয়েসটিক প্রোগ্রামিং (NLP) এর যাত্রা শুরু করেছিলেন। NLP একটি আলাপ-আলোচনা, ব্যক্তিগত উন্নয়ন এবং মনোচিকিৎসা পদ্ধতি। রিচার্ড বেনডলার এবং জন গ্রিনভার-এর মতে স্নায়ুবিক প্রক্রিয়া’ (Neuro), ‘ভাষা’ (Linguistic) এবং আচরণের যে ধরণ সেটা আমরা অভিজ্ঞতার (Programming) মাধ্যমে শিখি; এই তিনটার মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক নিহিত আছে। এগুলোর মধ্যে আমরা পরিবর্তন এনে জীবনে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে পৌঁছাতে পারি। ঘখচ শিখার অর্থ হচ্ছে নিজের মনের ভাষা শিখা। মস্তিষ্কের জন্য নিউরো “লিংগুয়েসটিক প্রোগ্রামিং” ব্যবহারকারীদের দিক নির্দেশনা গ্রন্থ (Manual Book)। NLP প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার অর্থ এমন যে, কীভাবে আমরা আমাদের নিজেদের ভাষা বুঝতে বাস্তবে স্বচ্ছন্দ গতিতে ব্যবহার করতে পারব যাতে করে আমাদের সার্বক্ষণিক সহায়তাদানকারী, ‘সার্ভার’ ‘অবচেতন মন’ বুঝতে পারে আমরা প্রকৃতপক্ষে আমাদের বাস্তব জীবনে কি চাই।
রিচার্ড বেনডলার এবং জন গ্রিনভার আরো দাবি করেন যে, অহেতুক ভীতি, বিষাদগ্রস্থতা, মাংশপেশীর খিচুনি, মনো-দৈহিক অসুস্থতা, দূরে অস্পষ্ট দেখার সমস্যা, এ্যালার্জি, ঠান্ডা-সর্দি এবং শিক্ষক্ষেত্রে সমস্যা ইত্যাদি NLP এর একটি মাত্র সেশনই সমাধান সম্ভব।

আই মুভমেন্ট ডিসেনসিটাইজেশন এন্ড রিপ্রসেসিং (EMDR)

আই মুভমেন্ট ডিসেনসিটাইজেশন এন্ড রিপ্রসেসিং (EMDR) একধরণের মনোচিকিৎসা পদ্ধতি; যেটি ফ্র্যানসিন সপিরো উদ্বাবণ করেছিলেন। এটি মানসিক আঘাত (Trauma) ক্লায়েন্টদের সাহায্য করার অভিপ্রায়ে চোখ নড়াচড়া বা অন্যকোনো ধরনের দ্বিমুখী উত্তেজনা (Bi Lateral Stimulation) ব্যবহার করা হয়। EMDR একধরণের মনোচিকিৎসা পদ্ধতি যেটি মূলত মানসিক আঘাতপ্রাপ্তদের দুর্দশা দূর করার জন্য আবিস্কৃত হয়েছিল। (সাপিরো, ১৯৮৯ এ, ১৯৮৯, বি)। সাপিরো এর ‘এ্যাডাপটিভ ইনফরমেশন প্রসেসিং মডেল’ EMDR থেরাপি যেটি কষ্টদায়ক বা বেদনাদায়ক স্মৃতি উপলব্ধি এবং প্রক্রিয়াকরণ করার এবং জীবনের অন্যান্য প্রতিকূল অভিজ্ঞতাগুলোকে একটা পর্যায়ে এনে অভিযোজন করে সমাধানে পৌঁছায় সেটাকে সত্য বলে স্বীকার করে নেয়। একটা সফল EMDR পদ্ধতিতে চিকিৎসার সময় ক্লায়েন্টকে অনেক সমস্যা সৃষ্টিকারী অবেগীয় উপাদানের সামনে কিছু সময় ধরে রাখা হয় একই সময় ক্লায়েন্টকে বাইরের অন্যান্য বিষয়গুলোর দিকেও লক্ষ্য রাখতে হয়। একই সংগে দুই-চোখ নাড়াতে EMDR সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত বাহ্যিক উদ্দীপনা । এছাড়াও অনেকে হাত দ্বারা মৃদু আঘাত এবং শব্দ উদ্দীপনাও ব্যবহার করে থাকেন (সাপিয়ের ১৯৯১), (সাপিয়ের ১৯৯৫, ২০০১)। এটা অনুমান করেছিলেন যে, EMDRপদ্ধতি কষ্টদায়ক স্মৃতির নেটওয়ার্ক উপলব্ধি করতে সহায়তা করে, যাতে করে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ বৃদ্ধি পায়, নতুন এসোসিয়েশন গড়ে উঠে অর্থাৎ কষ্টদায়ক স্মৃতিগুলো আরো বেশী খাপ খাইয়ে নেওয়ার মত স্মৃতিতে বা তথ্যে রূপান্তরিত হয়। এই নতুন এসোসিয়েশনকে ভাবা হয় যে, এটা সম্পূর্ণ তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ফল, নতুন একধনরনের শিক্ষা, কষ্টদায়ক আবেগীয় স্মৃতিগুলোকে বাদ দেওয়া এবং মানুষের অভ্যন্তরীণ স্মৃতি, চিন্তন, কল্পনাতে উন্নতি ঘটে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, EMDR প্রচন্ড মানসিক আঘাতপ্রাপ্তদের পরবর্তী (PTSD) এর জন্য কার্যকরী। বিভিন্ন ডাক্তারগণ বলেছেন যে, EMDR পদ্ধতি নিম্নোক্ত সমস্যা সারাতে খুবই কার্যকরী : আকস্মিক ভয়, অহেতুক আতঙ্ক, ঝঁঞ্ছাটপূর্ণ স্মৃতি, বিষম মনোবেদনা, ব্যথা সম্পর্কিত রোগ, কাজ সম্পর্কিত উদ্বেগ, মানসিক চাপ, যৌন অথবা শারীরিক নির্যাতন, ব্যক্তিত্ব সম্পর্কিত সমস্যা ইত্যাদি।